গাজায় যুদ্ধবিরতি: ইসরাইলের পরাজয়
১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৮ এএম | আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৮ এএম
প্রায় ১৫ মাস ধরে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যা চালিয়েও হামাসের নেটওয়ার্ক ধ্বংস কিংবা জিম্মি ইসরাইলিদের উদ্ধার করতে পারেনি আইডিএফ। জেরুজালেমে ইহুদি সেনাদের অবৈধ অনুপ্রবেশ এবং মুসলমানদের নিগ্রহ, ধারাবাহিক ভূমি দখল ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ২০২৩ সালের ৭ আগস্ট হামাসের অপারেশন আল আকসা ফ্লাড পরিচালিত হয়। কয়েক হাজার হামাস যোদ্ধা অভিনব পদ্ধতিতে ইসরাইলে প্রবেশ করলে সম্মুখযুদ্ধে প্রায় ১২শ ইসরাইলী নিহত হয়। কয়েকশ’ সামরিক-বেসামরিক ইসরাইলিকে বন্দি করে গাজায় নিয়ে যায় হামাস। সেই বন্দি বা জিম্মিদের মুক্তি এবং হামাসকে নির্মূল করার ইস্পাত কঠিন শপথ নিয়ে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু নজিরবিহীন যুদ্ধ ঘোষণা করে প্রতিদিন শত শত টন বোমা ফেলে গাজাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে; সেখানে স্থল অভিযান চালিয়ে হামাসের টানেল নেটওয়ার্ক ধ্বংসের ঘোষণা দেয়। যুদ্ধের কোনো নিয়ম-নীতি না মেনে বেসামরিক মানুষ হত্যা, খাদ্য, পানি, বিদ্যুৎ, জ্বালানিসহ সব ধরনের সরবরাহ বিচ্ছিন্ন করে, বাড়িঘর, জনপদ, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, মসজিদ, গির্জা, খাদ্য গুদাম, খেত-খামার, আশ্রয়কেন্দ্রসহ সবকিছু ধ্বংস করে দিয়ে সেখানে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করা হয়। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইসরাইলি নেতাদের যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করেছে। যুদ্ধের শুরুতেই মধ্যপ্রাচ্য এবং পশ্চিমা বিশ্বের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ শহরের হাজার হাজার মানুষ যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব ও জিম্মি মুক্তি ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে রাস্তায় নামলেও ইসরাইলের যুদ্ধবাজ সরকার হামাস-হেজবুল্লাহকে ধ্বংস করে জিম্মিদের মুক্ত করা ছাড়া অন্য কোনো প্রস্তাব মানবেন না বলে বার বার দৃঢ় সংকল্প প্রকাশ করেছিলেন। দেশি-বিদেশি চাপে গত বছর এক দফায় ৭ দিনের যুদ্ধবিরতিতে কিছু বন্দি বিনিময় ছাড়া আইডিএফ একজন জিম্মিকেও মুক্ত করতে পারেনি। এমন ব্যর্থতার গ্লানি মাথায় নিয়ে অবশেষে ইসরাইল হামাসের শর্ত মেনে যুদ্ধ বিরতি চুক্তি মেনে নিতে বাধ্য হল।
কাতার, মিশর ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় গাজায় একটি যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব নিয়ে মাসের পর মাস ধরে দর কষাকষি চলছিল। তবে গাজায় গণহত্যা একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। একটি যুদ্ধ বিরতিতে উপনীত হওয়ার আগে গত ১৫ মাসে গাজায় ৪৭ হাজারের বেশি মানুষকে নির্বিচার হত্যা করা হয়েছে। আহত হয়েছেন অন্তত ১ লাখ ২০ হাজার মানুষ। গাজার ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ এই যুদ্ধে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। সর্বাত্মক ব্লকেড, বোমা বর্ষণ, স্থল হামালার ধ্বংসযজ্ঞ ও টার্গেটেড কিলিংয়ের মধ্য দিয়ে গাজার ২৩ লাখ বাসিন্দা চরম খাদ্য সংকট ও দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়েও প্রিয় মাতৃভূমি ও আল আকসার মুক্তির প্রশ্নে শহীদি তামান্না, হামাসের প্রতি তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন ও জাতীয় ঐক্য ইঙ্গ-মার্কিন সমর্থিত জায়নবাদী যুদ্ধাপরাধীদের পিছু হটতে বাধ্য করেছে। হামাসের অকুতোভয় যোদ্ধা, ফিলিস্তিনের নারী-শিশুসহ প্রত্যেক নাগরিক দেশপ্রেম ও ইমানি চেতনার এক সুমহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। হামাস-হেজবুল্লা-হুতিসহ ইরান সমর্থিত প্রতিরোধ যোদ্ধাদের রকেট হামলায় ইসরাইলের লাখ লাখ অধিবাসী দেশ ছেড়ে ইউরোপ-আমেরিকায় পাড়ি জমালেও মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও গাজার অধিবাসীরা নিজেদের মাটি ছেড়ে পালিয়ে যায়নি। ‘বাঁচলে এখানেই বাঁচব, মরলে এখানেই মরব’ এমন পণ করেই তারা যুদ্ধের বিভীষিকার সাক্ষী হয়ে, স্বজন হারিয়ে, বাস্তু হারিয়ে যুদ্ধ জয়ের মিছিলে সামিল হতে হয়েছে। গাজার মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ের এক নতুন ইতিহাস রচনা করেছে। আলোচিত যুদ্ধ বিরতি চুক্তিতে উভয় পক্ষের সম্মতিকে হামাস ও গাজাবাসীর বিজয় হিসেবে দেখা হলেও ১৫ জানুয়ারিতেও গাজায় বোমা হামলা ও গণহত্যা অব্যাহত ছিল। আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাপে হামাসের শর্ত মেনে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব মেনে নিলেও যুদ্ধাপরাধী ইসরাইল যুদ্ধ বিরতির চুক্তি কতটা মেনে চলবে, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে।
আরবদের জমি দখল করে ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, আরব-ইসরাইল যুদ্ধ ও শান্তির আলোচনা পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী এজেন্ডা বা নীল নকশার অংশ। বাইডেন প্রশাসন একদিকে পনের মাস ধরে যুদ্ধ বিরতির নাটক করেছে, অন্যদিকে ইসরাইলকে আরো বেশি আগ্রাসী হয়ে উঠতে মাস ডেস্ট্রাক্টিভ যুদ্ধাস্ত্র, যুদ্ধ বিমান, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং শত শত কোটি ডলারের সামরিক বাজেট সহায়তা দিয়ে যুদ্ধকে জিঁইয়ে রেখেছে। গত নভেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেনের পরাজয়ের পেছনে নেতানিয়াহুর যুদ্ধনীতির প্রতি তাঁর নিঃশর্ত সমর্থন এবং ইউক্রেনের যুদ্ধ পরিস্থিতির প্রভাব থাকার কথা বলা হয়। যদিও নেতানিয়াহুর গ্রেটার ইসরাইল পরিকল্পনা এবং মধ্যপ্রাচ্যকে নতুন যুদ্ধের ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেয়ার জন্য ডোনাল্ট ট্রাম্পের প্রথম পর্বে জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থাপন, আব্রাহাম অ্যাকর্ড, ডিল অব দি সেঞ্চুরি এবং ইরানের সাথে ৬ জাতির পারমানবিক সমঝোতা চুক্তি থেকে একতরফাভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহারকে দায়ী করা যায়। তবে এবারে দুই পক্ষকে একটি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত করার কৃতিত্ব দাবি করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্প এখনো দায়িত্ব গ্রহণ না করলেও হোয়াইট হাউজ বা জো বাইডেনের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো বার্তা প্রকাশিত হওয়ার আগেই ডোনাল্ড ট্রাম্পই প্রথম হামাস-ইসরাইল যুদ্ধ বিরতির সংবাদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। হামাসের সাথে বন্দি বিনিময় চুক্তিতে উপনীত হতে সহায়তার জন্য ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু জো বাইডেন এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। কাতারের প্রধানমন্ত্রীর বরাতে প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায়, প্রথম দফায় হামাস ৩৩ জন জিম্মিকে মুক্তি দেবে। এর মধ্যে স্থায়ী যুদ্ধ বিরতির আলোচনা সফল হলে বাকি জিম্মিদেরও মুক্তি দেয়া হবে। পরবর্তী ধাপে যুদ্ধে মৃত জিম্মিদের লাশ হস্তান্তর এবং গাজা পুনর্গঠনের কার্যক্রম শুরু হতে পারে। তবে সবকিছু নির্ভর করছে উভয়পক্ষ, বিশেষত ইসরাইলের যুদ্ধ বিরতি চুক্তি মেনে চলার উপর। পশ্চিমা বিশ্বের পুরো সমর্থন ও সামরিক সহায়তা নিয়ে ইসরাইল গাজা ও লেবাননে নৃশংস গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করেছে। কিন্তু হামাস বা হেজবুল্লাহর বিরুদ্ধে কোনো কৌশলগত বিজয় লাভ করতে পারেনি। উপরন্তু ইরানের মিসাইল হামলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। বিশ্ব সম্প্রদায়কে অবশ্যই যুদ্ধাপরাধের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। সেই সাথে স্থায়ী যুদ্ধ বিরতি, গাজা পুনর্গঠন এবং ৬৭ সালের পূর্ববর্তী সীমারেখার আলোকে পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দ্বিরাষ্ট্রকেন্দ্রিক সমাধানের বাস্তবায়ন করতে হবে। গাজা ও ফিলিস্তিনের সংগ্রামী জনগণ এবং হামাস-হেজবুল্লাহসহ প্রতিরোধ অক্ষগুলোর প্রতি আমাদের আন্তরিক মোবারকবাদ বা শুভ কামনা রইল।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
নরসিংদীতে বাস-ট্রাকের ত্রিমুখী সংঘর্ষ, আহত ৮
পাবনায় জনজীবনে ভয়াবহ হচ্ছে ভার্চুয়াল আসক্তি
মাঝ আকাশে ভেঙে টুকরো ইলন মাস্কের ‘স্টারশিপ’
বাংলাদেশ-ভারতকে অতীত কবর দিয়ে নতুন করে শুরু করতে হবে: সুনন্দা কে দত্ত রায়
সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন
সাইফ ইস্যুতে কেজরিওয়ালের বিস্ফোরক মন্তব্য, পাল্টা প্রতিক্রিয়া বিজেপি নেতার
ট্রাম্পের শুল্ক ছাড়াও চীনের অর্থনৈতিক সংকটে তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ !
খেজুরের রস খেতে গিয়ে গাড়িচাপায় মোটরসাইকেলের ৩ আরোহী নিহত
দিয়ালোর দুর্দান্ত হ্যাটট্রিকে ইউনাইটেডের নাটকীয় জয়
আজারবাইজান-জর্জিয়া সম্পর্ক শক্তিশালীকরণে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক
আসাদগেটে সিএনজি-ট্রাক সংঘর্ষ, একজনের মৃত্যু
মরক্কোতে নৌকা ডুবে ৪৪ পাকিস্তানির মৃত্যু
'বন্ধী মুক্তির চুক্তি' চূড়ান্ত জানিয়েছে নেতানিয়াহুর দপ্তর
সুদানের সেনাপ্রধানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ যুক্তরাষ্ট্রের
উ. কোরিয়ার ইউক্রেনে সামরিক অংশগ্রহণ একটি কৌশলগত ভুল : রব বাউয়ার
সাইফ তো লিস্টে ছিল না,হঠাৎ হামলা হয়ে গেছেঃ মমতা
ঘণকুয়াশায় সাড়ে ৫ ঘন্টা আরিচা-কাজিরহাট এবং ৪ ঘন্টা পর পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে ফেরি চলাচল শুরু হয়েছে
মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা আজ, মানতে হবে যেসব নির্দেশনা
ফেসবুকে নিজের সম্পদের হিসাব দিলেন প্রেস সচিব
স্লোভাকিয়ায় স্কুলে শিক্ষার্থীর ছুরিকাঘাতে নিহত ২